মিথ্যা মামলা থেকে বাচার উপায়

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আপনার বিরুদ্ধে যে কোন সময়  মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা বা অন্য কোন মিথ্যা মামলা হয়ে যেতে পারে তাই আপনাকে রাজনৈতিক মামলা থেকে বেঁচে থাকতে হলে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা মামলা থেকে বেঁচে থাকাটা নানা রকম কারণে একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার তারপরও আপনার নিজেকে রক্ষা করার জন্য কিছু ব্যবস্থা তো গ্রহণ করতেই হবে। মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচার জন্য আপনাকে দুটি উপায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে একটি হলো মামলা হওয়ার আগে এবং আরেকটা হল মামলা হওয়ার পরে। একবার মামলা হয়ে গেলে তা থেকে রক্ষা পাওয়াটা একটু জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

আসুন জেনে নেই মামলা হওয়ার আগে সতর্কতামূলক কি কি ব্যবস্থা নিতে পারেন।

  • বর্তমান পরিস্থিতিতে পারতপক্ষে সকল প্রকাশ রাজনৈতিক ঝামেলা থেকে দূরে থাকুন
  • বেফাস কথাবার্তা বলে শুধু শুধু রাজনৈতিক জামেলায় জাড়াবেন না।

এখন আলোচনা করব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে

তার আগে জেনে নিই CDR কি? CDR (Call detail records) হল এমন এক ধরনের তথ্য বিবরনী যা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অথবা মোবাইল অপারেটর কর্তৃক প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। CDR প্রস্তুত করা হয় একজন অপেরাটর কর্তৃক প্রদেয় গ্রাহক নাম্বারের (মোবাইল বা কন্টাক্ট নাম্বার ) উপর ভিত্তি করে,  যা থেকে উক্ত মোবাইল ফোন গ্রাহকের মোবাইল কল, এসএমএস (খুদে বার্তা) সংক্রান্ত সকল তথ্যাদির বিষদ বিবরণ পাওয়া সম্ভব। CDR প্রস্তুত করার মুল কারণ অবশ্য এসব তথ্য বিশ্লেষণ নয়। একজন গ্রাহক অপর গ্রাহকের সাথে কত সময় কথা বলছেন, কতগুলো এসএমএস আদান প্রদান করছেন, গ্রাহক কত মিনিট ইন্টারনেট ব্রাউজিং করছেন, এই বিষয়গুলোর চুলচেরা হিসেব করার লক্ষ্যেই মূলত CDR ডাটা প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। CDR ডাটার মাধ্যমে আরও যে বিষয়গুলো উঠে আসে তার মধ্যে মুখ্য হল একজন গ্রাহকের ব্যাবহৃত অপারেটর, কোন একটি কল করার বা শুরুর সঠিক সময় (তারিখ ও সময়), কলটির স্থায়িত্ব, স্থান, কল কেটে দেয়া বা শেষের সময়, যে ব্যক্তিকে কল করা হয়েছে তার নাম্বার, উভয় (যিনি কল করেছেন, যার কাছে কল করা হয়েছে) মোবাইলের IMEI (International Mobile Equipment Identity) নাম্বার, উভয়ের IMSI (International Mobile Subscriber Identity) নাম্বার যা কি না প্রতিটি SIM কার্ডের জন্য একক ও অদ্বিতীয়, উভয়ের Base Station (সহজভাবে বুঝার জন্য – নিকটবর্তী মোবাইল এন্টেনা) এর তথ্য ইত্যাদি। এমনকি গ্রাহকের ব্যাবহৃত নেটওয়ার্ক টাইপ – টু জি / থ্রি জি, ভয়েস কল, এসএমএস বা ইন্টারনেট ডাটা – এসব তথ্যও বেশ নিখুঁত ভাবে CDR ডাটাতে পাওয়া যায়।

সিডিআর কিভাবে মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচাতে

এখানে সিডিআর মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচাতে আপনাকে মারাত্মকভাবে সহযোগিতা করতে পারে।  তার জন্য আপনার উচিত আপনি যে মোবাইল সিম ব্যবহার করেন তার রেজিস্ট্রেশন নিজের নামে করা এবং অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত  সিম পরিহার করা। এবং আপনার নামে যদি এমন কোন সিম থেকে থাকে যা আপনি ব্যাবহার করছেন না, তা অতিসত্ত্বর বন্ধ করে দিন।  নিজের নামের সিম ব্যবহার করলে কিভাবে সুবিধা পাবেন তা আলোচনা করছি।

যেমন ধরুন আপনাকে একটি মিথ্যা মামলা আসামি করা হলো যে মামলাটির ঘটনাস্থল দেখানো হলো বনানী এবং সময় বিকাল ৩ ঘটিকা কিন্তু বাস্তবে ঐই সময়ে আপনি ছিলেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায়। তাহলে এখানে প্রমাণ হয় আপনি মামলায়  উল্লেখিত ঘটনার সাথে কোন ভাবে জড়িত নন। তারপরও কিন্তু আপনার নামে মামলা হয়ে গেল, কিন্তু আপনি সুবিধা পাবেন তখন, যখন তদন্ত কর্মকর্তা সিডিআর পর্যালোচনা করে দেখবে আপনি ওই সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না, তখন কিন্তু আপনি মিথ্যা মামলা থেকে বেঁচে যেতে পারেন।

সুতরাং আপনাকে ব্যবহৃত মোবাইল ও তার সিম আপনাকে মিথ্যা ও হয়রানি মূলক মামলা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

মিথ্যা মামলা হয়ে গেলে করণীয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

প্রথমে আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনি অপরাধী, না নিরপরাধ, সেটি মামলায় অভিযুক্ত হলেই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। আইনের চোখে আপনার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আপনি নিরপরাধ। ধরুন, আপনার বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা হলো। আপনি দোষী বা নির্দোষ, সেটি পরে প্রমাণিত হবে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে আপনি যেন এ মামলা সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা করতে পারেন, সেই চেষ্টা করতে হবে।

থানায় মামলা হলে করণীয় –

  • যদি আপনার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়, তাহলে এজাহারের কপিটি সংগ্রহের চেষ্টা করুন। আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করুন। মামলার এজাহারে দেখতে হবে, অভিযোগগুলো জামিনযোগ্য বা জামিনঅযোগ্য কি না। অভিযোগ তেমন গুরুতর না হলে এবং জামিনযোগ্য হলে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারেন।
  • যদি এমন হয় যে আপনি জানতে পারলেন না, আপনার বিরুদ্ধে থানায় এজাহার হয়েছে। পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেপ্তার করল। আপনাকে থানায় নিয়ে গেল। গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে। তখন আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে হবে। যদি রিমান্ড চায় পুলিশ, তাহলে আপনার আইনজীবীর উচিত হবে রিমান্ড বাতিলের জন্য আবেদন করা। যদি জামিন দেন আদালত, তাহলে একজন পরিচিত জামিনদারের জিম্মায় আপনার জামিননামা সম্পাদন করতে হবে। যদি জামিন না হয়, তাহলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে আবেদন করতে হবে।
  • নিম্ন আদালতে অব্যাহতি না পেলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে অভিযোগ জামিন-অযোগ্য হলে অনেককে হাইকোর্ট বিভাগে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে আগাম জামিন চাইতে দেখা যায়। হাইকোর্ট বিভাগ আগাম জামিন সাধারণত নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। এ মেয়াদের মধ্যেই নিম্ন আদালতে গিয়ে জামিননামা সম্পাদনের জন্য আবেদন করতে হবে। আদালতে প্রতি তারিখে হাজিরা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া অনুপস্থিত থাকলে আপনার জামিন বাতিল করে দিতে পারেন আদালত।
  • জামিন সাধারণত পুলিশ প্রতিবেদন হওয়ার আগেই চাইতে হয়। তবে পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করার আগে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আপনার বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অভিযোগটি দায়ের করা হয়েছে, তা প্রমাণের চেষ্টা করুন। তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবেন। চার্জশিট বা অভিযোগপত্র হয়ে গেলে আপনার মামলাটি বিচারিক আদালতে বদলি হবে। অভিযোগ গঠনের দিন আপনাকে হাজির হয়ে নতুন করে পূর্বশর্তে জামিন চাইতে হবে এবং জামিননামা সম্পাদন করতে হবে। তখন আপনি মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন।

আদালতে মামলা হলে করণীয় –

যদি থানায় মামলা না হয়ে আদালতে মামলা (সিআর মামলা) হয়, তাহলে আদালত সমন দিতে পারেন কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। এক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। মামলা সাক্ষ্য পর্যায়ে গেলে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। যদিও মামলার অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ যিনি মামলা করেন তাঁর ওপর বর্তায়। অনেক সময় মিথ্যা মামলা হলে মামলাকারী মামলা ঠুকে দেওয়ার পর আর হাজির হন না। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি তারিখ যাওয়ার পর মামলা থেকে খালাস পাওয়ার জন্য আবেদন করার সুযোগ আইনে রয়েছে।

হাইকোর্ট বিভাগে জামিন-

ক্ষেত্রবিশেষে হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন চাইতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সিআর মামলায় অভিযুক্ত সব আসামি হাজির হলেই বিচারের জন্য মামলাটি বদলি করা হয়। আপনি কোনো কারণে হাজির না হলে আপনার জামিন বাতিল হতে পারে। পর্যায়ক্রমে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি হতে পারে। এতে হাজির না হলে আপনার মালামাল ক্রোকের আদেশ হতে পারে এবং আপনার অনুপস্থিতিতেই বিচার হতে পারে।

মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে করণীয়-

সাক্ষ্যপ্রমাণে আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে আপনি প্রচলিত আইনেই মামলা দায়ের করতে পারেন।

  • দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে পারেন।
  • নারী ও শিশু নির্যাতনের মিথ্যা মামলার শিকার হলে আইনের মধ্যে থেকেই আদালতে লিখিত পিটিশন দায়ের করার মধ্য দিয়ে প্রতিকার পেতে পারেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের দায়ে অপরাধীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
  • মিথ্যা মামলাকারী সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে আদালত ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ করতে পারেন। এ ছাড়া কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয়—এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তাঁর বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

সুতরাং আইনে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাজার বিধান রয়েছে এবং আপনি চাইলেই ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

মোঃ মাইনউদ্দিন
অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট , ঢাকা।

About the Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may also like these